পাতক্ষীর
মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর ২০০ বছর ধরে ভোজনরসিকদের কাছে প্রিয়

দুগ্ধ জাতীয় মিষ্টান্ন খাবারটির নাম পাতক্ষীর। কেউ বলেন ক্ষীরসা বা পাতাক্ষীর, আবার কেউ বলেন পাতক্ষীরা। খেতে অত্যন্তসুস্বাধু। মানেও খাঁটি।
২০০ বছর ধরে ভোজনরসিকদের খাবার তালিকার প্রিয় মিষ্টান্ন খাবার রাজধানীর উপকন্ঠ মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের এইপাতক্ষীর। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সুখ্যাতি। ইউরোপ ও আমেরিকার বাঙ্গালী কমিউনিটির অনেকেই পাতক্ষীর কিনে নিয়েযান। সেখানকার মিষ্টিপণ্যের দোকান বা সুপারশপেও বিক্রি করে থাকেন অনেকে। এছাড়া ফ্রান্স, ইতালি ও ভারত প্রবাসীরাপ্রতি বছর এ পাতক্ষীর কিনে নিয়ে যান।
এদিকে, জেলার সিরাজদীখানের জগত বিখ্যাত এ পাতক্ষীর জিআই পন্যের স্বীকৃতি পেতে আবেদন করা হয় ২০২৪ সালের ২৫ফেব্রুয়ারী। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুজাফর রিপন ওই আবেদন করেন।
অবশেষে ভৌগোলিক নির্দেশক জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর জিআই পন্যের স্বীকৃতি পেয়েছে জেলার সিরাজদীখানউপজেলার মিষ্টান্ন এ পাতক্ষীর। অর্জিত হলো ঐতিহ্যের মুকুট। জিআই পন্যের স্বীকৃতির খবর পৌছতেই উপজেলারসন্তোষপাড়া গ্রামের কারিগরদের মধ্যে বইছে আনন্দবন্যা ও খুশির জোয়ার। এ খবরে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
সিরাজদীখানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাতক্ষীর। মিশে আছে এ অঞ্চলের খাবার সংস্কৃতির সঙ্গেও। লিপিবদ্ধ কোনোইতিহাস না থাকলেও মোঘল আমলে ঢাকাবাসীর খাবার তালিকায় পাতক্ষীরের নাম পাওয়া যায়। লোকমুখে জানা যায় যে, প্রায় ২০০ বছর আগে বিক্রমপুর তথা সিরাজদীখানেই পাতক্ষীরের উৎপত্তি। সে সময় পুলিন বিহারী দেব নামে এক ব্যক্তিরহাত ধরেই পাতক্ষীর আসে এ অঞ্চলে। উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের সন্তোষপাড়া গ্রামের ঘোষ বাড়িতে তিনিই প্রথমে তারস্ত্রীকে নিয়ে দুগ্ধ এ মিষ্টান্ন তৈরী শুরু করেন। তিনি ও তার স্ত্রীর তৈরী এ পাতক্ষীর সেসময় জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করাহতো।
পুলিন বিহারী ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে শিখে একই সময়ে ইন্দ্রমোহন ঘোষ এবং লক্ষ্মী রানী ঘোষের পরিবার তৈরি করতে শুরুকরেন এটি। এখন তাদের বংশধররাই বানাচ্ছেন এই ক্ষীর। উত্তরসূরি কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীল চন্দ্র ঘোষ, রমেশঘোষ, বিনয় ঘোষ, মধুসূদন ঘোষ, সমীর ঘোষ ও ধনা ঘোষ এই পেশায় ধরে রেখেছেন। এই পাতক্ষীর পারিবারিক ঐতিহ্য ওব্যবসা হলেও পরিবারের মেয়েদের মিষ্টান্ন বানানোর রীতি শেখানো হয় না। এই পদ্ধতি রপ্ত করে পরিবারের পুত্রবধূরা। কেননামেয়েরা বিয়ের পর অন্যত্র চলে যায়। তাই মেয়েদের হাত হয়ে যাতে তাদের এটি বানানোর পদ্ধতি বিয়ের পর হস্তান্তর না হয়।তবে বর্তমানে দোকানের কারিগররাই পাতক্ষীর তৈরি করে থাকেন।
অন্যদিকে, উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার বংশ পরম্পরায় এ পাতক্ষীর তৈরীর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।দুধের তৈরি পাতক্ষীর কলা পাতায় মোড়ানো থাকে। দেখতে হালকা হলুদাভ বর্ণের, চ্যাপ্টা এবং গোলাকৃতির। প্রতি পাতায়প্রায় ৫০০ গ্রাম পাতক্ষীর থাকে। প্রায় ৬ কেজি দুধ জ্বাল করে ১ কেজি পাতক্ষীর বানানো হয়। এই এলাকায় প্রচুর গাভী পালনকরা হয়, তাই প্রচুর পরিমানে দুধ পাওয়া যায়। তাই পাতক্ষীর তৈরীর জন্য দুধ এ অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন শুধুমাত্র সিরাজদীখান বাজারে প্রায় ২০০ মন দুধ বিক্রি হয়। গরমের তুলনায় শীতেই পাতক্ষীর বেশী বিক্রি হয়। এসময়পাটিশাপটা, মুখশোলা, ক্ষীরপুলির মত নানা রকম পিঠাপুলির ধুম পড়ে যায়।
এই অঞ্চলের নানা উৎসব–আয়োজনে পাতক্ষীরের পরিবেশনা থাকবেই। এটি না হলে যেন আয়োজন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।তাই এই এলাকার মেহমানদারি বা বড় বড় আয়োজনে পাতক্ষীর থাকা চাই। এমনকি এই এলাকায় নতুন জামাইয়ের সামনেপিঠাপুলির সঙ্গে পাতক্ষীর বাদে চিন্তাও করা যায় না।
জেলার সিরাজদীখান বাজারে পাতক্ষীরের ১৭ টি দোকান রয়েছে। এরমধ্যে রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, মা ক্ষীর ভান্ডার, জগন্নাথমিষ্টান্ন ভাণ্ডার, সমীর ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মহাগুরু মিষ্টান্ন ভান্ডার উল্লেখযোগ্য।
গরমের সময় একেকটি দোকানে দৈনিক গড়ে ৪০–৫০ পাতা পাতক্ষীর বিক্রি হয়ে থাকে। এক পাতায় ৫০০ গ্রাম পাতক্ষীরমোড়ানো হয়। তবে শীতকালে বিক্রি বাড়ে। এসময় প্রতি দোকানে দৈনিক গড়ে ২০০–২৫০ পাতা পাতক্ষীর বিক্রি হয়। এককেজি সুস্বাদু পাতক্ষীর ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। তবে দুধের দাম কম–বেশীর সঙ্গে পাতক্ষীরেরদাম উঠানামা করে। কারিগররা জানান, প্রথমে সামান্য আঁচে দুধ গরম করে ঢালা হয় বড় কড়াইয়ের মতো দেখতে তাফালে।এরপর এক ঘণ্টা সেই দুধ জ্বাল দিয়ে কিছুটা ঘন করে মেশানো হয় হলুদগুঁড়া। আবারও আধা ঘণ্টা ধরে জ্বাল দেওয়ার পরযোগ করা হয় চিনি।
সিরাজদীখান বাজারের রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সহোদর তিন ভাই শরৎ ঘোষ, মাদব ঘোষ ও খোকন ঘোষ পাতক্ষীর তৈরীরসঙ্গে জড়িত।
খোকন ঘোষ (৭০) জানান, পারিবারিক ভাবেই এ পাতক্ষীর তৈরী করে আসছেন। ৪ পুরুষ ধরে পাতক্ষীর তৈরী করে আসছেতাদের পূর্ব পুরুষরা। তবে তার ভাই প্রয়াত সুনীল ঘোষ প্রথমে বাজারে মিষ্টির দোকান চালু করেছিলেন। তিনি ছিলেন পাতক্ষীরতৈরির অন্যতম কারিগর। ভাইয়ের কাছ থেকেই তার ২ ভ্ইা ও সন্তানদের ক্ষীর বানানোর হাতেখড়ি।
বর্তমানে ঘোষ পরিবার ছাড়াও উপজেলার আরও কয়েকটি পরিবার পাতক্ষীর তৈরি ও বিক্রি করেন। এক কেজি পাতক্ষীর৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন।
মহাগুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী সুশান্ত ঘোষ বলেন, সাধারণত ক্ষীর প্রস্তুত করতে অনেক পরিমাণ দুধকে জ্বাল দিয়েপরিমাণে কমিয়ে ঘন করা হয়। পাতক্ষীর বানাতেও প্রচুর পরিমাণ দুধ পাতিলে ঢেলে দীর্ঘসময় ধরে জ্বাল দিতে দিতে কাঠেরচামচ দিয়ে নাড়তে হয়, যাতে পাতিলের তলায় দুধ লেগে না যায়। এরপর দুধ ঘন হয়ে এলে সামান্য হলুদ ও পরিমিত পরিমাণচিনি মিশিয়ে চুলা থেকে নামানো হয়। পরিমানের অনুপাত যদি ধরা হয় তাহলে ৩০ লিটার দুধে ৭৫০ গ্রাম চিনি ও দুই চা চামচহলুদ বাটা মিশিয়ে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া ও নাড়াচাড়া করতে হয়। এভাবেই ৬ কেজি দুধ থেকে প্রস্তুত হয় ১কেজি পাতক্ষীর।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলা হতে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন “পাতক্ষীর”-কে ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্যের সনদপ্রদান করা হয়।
বুধবার বিকালে পেটেন্ট, শিল্প–নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর–এর উদ্যোগে ফরেন সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ এরমাল্টিপারপাস হলে “বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও নিবন্ধনকৃত ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্যেরসনদ প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত সনদটি গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিবন্ধিত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবেসনদ প্রদান করা হয়।
বহু প্রজন্ম ধরে স্থানীয় কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি এই সুস্বাদু মিষ্টি মুন্সীগঞ্জবাসীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। দুধ, সামান্য হলুদগুড়া ও চিনি দিয়ে প্রস্তুতকৃত পাতক্ষীরের স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত বৈশিষ্ট্য একে দেশের অন্যান্য মিষ্টান্ন থেকেস্বতন্ত্র করে তুলেছে। GI সনদপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে এই পণ্যের মান ও স্বাতন্ত্র্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল, যা স্থানীয়উৎপাদকদের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ ওবায়দুররহমান।
আপনার মতামত লিখুন